সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন শেফালী বেগম। বিদ্যালয়ের পাশেই একটি মুদিদোকান। সেই সূত্রে দোকানির সঙ্গে পরিচয়। হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন দোকানি। যানবাহন না পাওয়ায় দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া গেল না তাঁকে। দোকানেই তাঁর মৃত্যু হয়। চোখের সামনে ঘটনাটি দেখে মনঃকষ্টে ভুগতে থাকেন শেফালী। ঠিক করেন, গ্রামের অসুস্থ মানুষকে বিনা ভাড়ায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে অ্যাম্বুলেন্স কিনবেন।
এ ঘটনার পর প্রতি মাসের বেতনের টাকা থেকে কিছু সঞ্চয় করতে শুরু করেন। পাঁচ বছরের জমানো টাকায় অ্যাম্বুলেন্স কিনেও ফেলেন। শুরু হয় রোগী পরিবহন। করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় রোগী পরিবহন বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন গ্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করে উপজেলা সদরে পাঠানোর জন্যও অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার করেন। প্রায় দুই বছরে অ্যাম্বুলেন্সটি ২৪০ জন রোগীকে বিনা ভাড়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মেরিগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শেফালী বেগম (৪৩)। তিনি উপজেলার নগর ইউনিয়নের দোগাছি গ্রামের ময়লাল হোসেনের স্ত্রী। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা যায়, তিনি ছোটবেলা থেকেই পরোপকারী স্বভাবের। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে স্নাতক পড়ার সময় মেরিগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। কিছুদিন পর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার আগ্রহ দেখান।
বিদ্যালয়ের পাশের মুদিদোকানির মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল ২০১৪ সালের। সেদিনই শেফালী অ্যাম্বুলেন্স কিনবেন বলে মনস্থির করেন। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে তিনি জমানো ৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি পুরোনো অ্যাম্বুলেন্স কেনেন। মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে একজন চালককে নিয়োগ দেন। নিজের ও চালকের মুঠোফোন নম্বর বিলি করে বিনা ভাড়ায় অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়ার প্রচারণা চালান। রোগী পরিবহনে গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাঘব হয়। এখন আশপাশের গ্রাম থেকেও তাঁর কাছে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন আসে।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় গ্রামের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হন। গ্রামের অন্য কোনো যানবাহন, এমনকি ভাড়ায় চালিত অ্যাম্বুলেন্সও করোনা রোগী পরিবহন করতে রাজি হয় না। তিনি করোনা রোগীদেরও সেবা দিতে শুরু করেন। এতে বেতনের টাকার একটা বড় অংশ জ্বালানি তেল কিনতে গিয়ে শেষ হয়। তবু তিনি সেবা দেওয়া বন্ধ করেন না। অবশ্য অবস্থাপন্ন রোগীদের স্বজনেরা তাঁকে তেল কিনতে দেন না। গ্রামে করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে উপজেলা সদরে পাঠানো নিয়ে শুরু হয় পরিবহন সমস্যা। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাঁকে তাঁর অ্যাম্বুলেন্সে করে নমুনা পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। শেফালী তাতেও রাজি হন।
জালোড়া গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত আমার বাবাকে মুমুর্ষূ অবস্থায় হাসপাতালে নিতে কোনো গাড়ি রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে শেফালী আপার অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয়। আমার বাবা বেঁচে যান। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
পাঁচবাড়িয়া গ্রামের দিনমজুর রমজান আলীর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর হঠাৎ ব্যথা শুরু হয়। সময়মতো হাসপাতালে নিতে না পারলে স্ত্রী-সন্তান দুজনেরই মারা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। রমজান আলী বলেন, ‘টাকার অভাবে অ্যাম্বুলেন্স ডাকার সাহস পাচ্ছিলাম না। অবশেষে শেফালী বেগমের বিনা ভাড়ার অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।’
শেফালীর স্বামী ময়লাল হোসেন ছোটখাটো ব্যবসা করেন। সংসারে দুই ছেলেমেয়ে। শেফালী বেগম বলেন, ‘সংসারের কিছুটা খরচ কমিয়ে আমি অ্যাম্বুলেন্স কিনেছিলাম। পরে অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ি। অনেক অনুরোধ করে একজন চালককে মাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে অ্যাম্বুলেন্সটি চালাতে রাজি করাই। জ্বালানি খরচ কেউ নিজের থেকে দিতে চাইলে নিই। যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁদের জ্বালানি খরচও আমি বহন করি। এখন অ্যাম্বুলেন্সটি আরও পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মেরামত করতে হচ্ছে। তাতে অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। এটা এখন আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আশাদুজ্জামান বলেন, ‘শেফালী বেগমের ফ্রি অ্যাম্বুলেন্সে অনেক প্রসূতি মা ও অসহায় রোগী উপজেলা হাসপাতালে আসেন। এতে আমাদের সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ওপর চাপ কমে। এ ছাড়া করোনার শুরুতে নমুনা সংগ্রহ করে তা সিভিল সার্জন অফিসে পৌঁছানোর মতো কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। শেফালী বেগম তাঁর অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে নমুনা পৌঁছে দিয়েছেন।’
বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শেফালী বেগমের ফ্রি অ্যাম্বুলেন্সসেবা স্বাস্থ্যসেবার এক অনন্য উদাহরণ। তিনি চাইলে আমরা তাঁকে কিছু সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করতে পারি।’
Post a Comment