সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গৃহস্থালি পণ্য ব্যবহারে এসেছে নানা পরিবর্তন। সহজে, স্বল্প খরচে ও কম সময়ে ব্যবহার করা যায়, প্রযুক্তিনির্ভর এমন পণ্যই বেছে নিতে চান সবাই। একসময় ওয়াশিং মেশিন বিলাসী পণ্য বলে মনে করা হতো, যা কেনা অনেকের জন্যই কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু এখন এর দাম চলে এসেছে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে। কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজে অনেকের ঘরেই আছে গৃহস্থালি এই পণ্যটি। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এর চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। শুধু ওয়াশিং মেশিন নয়, ব্লেন্ডার, রাইস কুকার, ইলেকট্রিক কেতলিসহ বিভিন্ন নিত্যনতুন পণ্যের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
এসব পণ্যের সম্ভাবনা দেখে উৎপাদন ও বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তারাও। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে বিশেষ সুবিধার ঘোষণা এসেছে। 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় যে কয়েকটি শিল্পে ১০ বছরের কর অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে, তার একটি গৃহস্থালি পণ্য। কিছু শর্ত মেনে হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদনকারীরা পাবেন এই সুবিধা।
বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করাই সরকারের লক্ষ্য। কর অব্যাহিত ছাড়াও এই খাতের ১২টি পণ্য উৎপাদনে রয়েছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক্কে দুই বছরের অব্যাহতি। এ ছাড়া এ ধরনের পণ্য তৈরিতে ১১টি মৌলিক কাঁচামালে শুল্ক্ক রেয়াতি সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গৃহস্থালি পণ্য খাতে বাজেটে দেওয়া সুবিধাগুলো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদন শুরু হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হবে বাংলাদেশে তৈরি গৃহস্থালি পণ্য।
যেসব পণ্য উৎপাদনে কর-শুল্ক্ক সুবিধা :গৃহস্থালি সারঞ্জামের মধ্যে ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক সেলাই মেশিন, ইন্ডাকশন কুকার, কিচেনহুড, কিচেন নাইভস উৎপাদনে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছরের কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের জুন পর্যন্ত এ সুবিধা কার্যকর থাকবে। রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার ও কম্প্রেসার উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি আগামী এক বছরের জন্য বহাল রাখা হয়েছে। নতুন করে ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার, প্রেশার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেনে দুই বছরের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা আগামী ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এর কম্প্রেসার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এক বছরের জন্য এবং এয়ারকন্ডিশনার ও এর কম্প্রেসারের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে।
শিল্পের মৌলিক কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্ক কমানো হয়েছে। এ সুবিধা টিভি, রেফ্রিজারেটর ও ওয়াশিং মেশিনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয়েছে। ফ্লাট রোল আয়রন নন অ্যালয় স্টিলে শুল্ক্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ইলেকট্র প্লেট কেটেট উইথ জিংকে ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৯টি কাঁচামালে শুল্ক্ক কমানো হয়েছে।
সুবিধা পাওয়ার শর্ত :কর সুবিধার অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে সরকার। এসব পণ্য কেবল উৎপাদনেই এই সুবিধা পাবে, সংযোজনে নয়। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অথবা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ থেকে উৎপাদক হিসেবে নিবন্ধিত হতে হবে। ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার তৈরিতে নূ্যনতম প্লাস্টিক জার, স্টেইনলেস স্টিল জার, ব্লেড বেস উৎপাদনের সক্ষমতা থাকতে হবে। ইলেকট্রিক কেটলির ক্ষেত্রে স্টেইনলেস স্টিল, বেস, টপ লিড, হেন্ডেল উৎপাদনের সক্ষমতা থাকতে হবে। আয়রন উৎপাদনে স্লো প্লেট, বেস কভার, টপ ক্যাসিং, মেটাল স্টিল উৎপাদন করতে হবে। রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেশার কুকার তৈরিতে আউটার শেল, মিডেল ফ্রেম, ইনার পট, হিটিং প্লেট উৎপাদনের সক্ষমতা থাকতে হবে।
এসব পণ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হবে। এর স্বপক্ষে বিভাগীয় কর্মকর্তার ঘোষণা দাখিল করতে হবে। ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আবেদন করতে হবে। এই আবেদনের পর এনবিআরের পরিদর্শন কমিটি অনুমোদন দিলেই সুবিধা পাওয়া যাবে। শর্ত না মানলে সুবিধা তাৎক্ষণিকভাব বাতিল হবে।
ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা :আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করের সুবিধা দেওয়ায় এই খাতের বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। বিনিয়োগের পরিমাণ এখনকার তুলনায় বহুগুণ বাড়াবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। রপ্তানির বাজার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন তারা। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে যেসব প্রতিষ্ঠান জমি ইজারা নেওয়ার প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, তাদের অনেকেই এই খাতে উৎপাদনের কথা চিন্তা করছেন। এ ছাড়া ওয়ালটন, আরএফএল, মিনিস্টার, যমুনা, র্যাংগসসহ বিভিন্ন কোম্পানি এই খাতে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সহসভাপতি এম এ রাজ্জাক খান সমকালকে বলেন, গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় এসএমই উদ্যোক্তারাও এই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হলে আগামী পাঁচ বছরে নতুন করে পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা যায়।
চাহিদা বাড়ছে দামও কমবে :করোনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ১০টি গৃহস্থালি সরঞ্জাম ব্যবহার বেড়েছে। যেমন- ইলেকট্রিক কেটলিতে গরম পানির ভাপ নেওয়া ও চা বানাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন অনেকে। ওয়াশিং মেশিন, ওভেনসহ অন্য বেশ কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবহারও বাড়ছে। আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, করোনার আগে মাসে ১০০টি ওয়াশিং মেশিনও বিক্রি করতে পারতেন না তারা। কিন্তু করোনা দেখা দেওয়ার পর কোনো কোনো মাসে দুই হাজারটির বেশি বিক্রি হয়েছে। এটা একটা বড় পরিবর্তন। এ ছাড়া ব্লেন্ডার ও জুসারের চাহিদাও বেশ বেড়েছে। তিনি বলেন, সরকার কর সুবিধা দেওয়ায় পণ্যের দাম কমবে। সব মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ব্যয় কমলে এর সুবিধা ক্রেতারাও পাবেন।
স্থানীয় বাজার :ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, দেশে গৃহস্থালি সামগ্রীর বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এখন গৃহস্থালি সরঞ্জামের দোকানে গেলে দেখা যাবে প্রায় অর্ধেক সনাতনী ও অর্ধেক আধুনিক প্রযুক্তি পণ্য। দেশীয় ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো অনেক পণ্যে বিক্রয়োত্তর সেবাও দিচ্ছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দাবি, দেশে গৃহস্থালি পণ্যসামগ্রীর বাজার অর্ধেক এখন তাদের দখলে। সরকারের দেওয়া সুবিধার ফলে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারের ৮০ ভাগই দেশীয় উদ্যোক্তাদের দখলে থাকবে বলে আশা করছেন তারা। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন শুরুর পর খুব দ্রুতই এসব পণ্যের আমদানি কমে যায়। এখন এসব পণ্যের মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ আমদানিকৃত। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিক গৃহস্থালি সামগ্রীতে যেভাবে দ্রুত এগিয়ে, ইলেকট্রনিক্স গৃহস্থালি সামগ্রীর ক্ষেত্রেও আগামীতে এমনটি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ খাতে বর্তমানে ৪০টির মতো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের বড় কোম্পানি আছে ১০টি। এর বাইরে ছোট ও মাঝারি কোম্পানি আছে ৩০টি।
Post a Comment